www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

দুই বছরে চালের দাম সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে বাংলাদেশে


 এগ্রিবার্তা ডেস্ক    ১ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৯:১৪   কৃষি অর্থনীতি  বিভাগ


দীর্ঘদিন ধরেই দেশে চালের বাজারে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। কভিডের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে গত দুই বছরে দেশে চালের দাম ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ায় চালের অন্যান্য বৃহৎ ভোক্তা দেশের চেয়েও এ বৃদ্ধির হার কয়েক গুণ বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব দেশের কোনো কোনোটিতে গত দুই বছরে চালের দাম কমেছে। আবার যেসব দেশে বেড়েছে, সেগুলোয়ও এ বৃদ্ধির হার সীমাবদ্ধ ছিল ১০ শতাংশের নিচে, যেখানে বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।

গোটা বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় বাংলাদেশ। বর্তমানে এখানকার অর্থনীতির সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও বড় ভূমিকা রাখছে চালের বাজার পরিস্থিতি। সর্বশেষ আমন মৌসুমের চাল বাজারে ওঠার পর থেকে দাম কিছুটা কমেছে ঠিকই। কিন্তু এশিয়ায় চালের ভোক্তা দেশগুলোর মধ্যে দামের উল্লম্ফনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলাদেশেই।

এফএও ও ইউএসডিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে বিদায়ী ২০২২ সালের একই সময় পর্যন্ত এশিয়ার ভোক্তা দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত চালের দাম কমেছে যথাক্রমে ১০ ও প্রায় ১৪ শতাংশ। দাম বেড়েছে ভারত ও পাকিস্তানে। এ দুই দেশে খাদ্যশস্যটির দরবৃদ্ধির হার যথাক্রমে প্রায় ৯ ও ৭ শতাংশ।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বরে রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের (স্বর্ণা/চায়না/ইরি) দাম ছিল ৪৫-৪৬ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ২০২২-এর নভেম্বরে তা ৫৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। সে হিসেবে এ সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে অন্তত ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম এশিয়ার অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক বেশি বলে বিভিন্ন সময়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। কিছুদিন আগেই এফএওর তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইউএসডিএ জানায়, প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম অন্তত ৭০ শতাংশ বেশি।

সর্বশেষ আমন মৌসুমের ধান বাজারে ওঠার পর চালের দাম কিছুটা কমতে দেখা যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পরেও দেশের বাজারে চালের দাম এখনো ভোক্তাদের জন্য অসহনীয় পর্যায়েই রয়েছে। চালের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের দরবৃদ্ধি এখন দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয়কে কমিয়ে দিচ্ছে। ২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব মারাত্মক এক অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কভিডের প্রাদুর্ভাবের সময়ে কর্মহীন হয়েছে প্রচুর মানুষ। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের অভিঘাত গোটা বিশ্বেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরেই এর আঘাত পড়েছে সবচেয়ে বেশি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রায়ই চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বাজারে খাদ্যশস্যটির দাম বারবার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার পেছনে প্রধানত সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবেই চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে দেখা যায়। এ মুহূর্তে বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ বাড়ানোও প্রয়োজন।

চালের বাজারমূল্য বারবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পেছনে বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়াকে দায়ী করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অর্থায়নসহ নানা বৈষম্যের কারণে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়েছে। এর সুবাদে বৃহদায়তনের ব্যবসায়ীরা আরো বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পেলেও বহু চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লেও চালের দাম কিন্তু খুব একটা বাড়েনি। চালের দাম সাধারণত সবসময়ই কাছাকাছি থাকে। চাল কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো থেকে খুব একটা আসে না। মূলত ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকেই বেশি আমদানি হয়। ডলারের ঊর্ধ্বগতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে চালের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু গত দুই বছরে দেশের বাজারে চালের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। চাল ব্যবসায়ীরা চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। চাল ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী। ফলে চালের দাম তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এজন্য সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরো শক্তিশালী হতে হবে।

গত বছরের আমন মৌসুমে দেশে চালের বেশ ভালো উৎপাদন হয়েছিল। বোরো মৌসুমেও ফলন হয়েছিল ভালো। কিন্তু গত জুনে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে আউশ মৌসুমের আবাদ কমে যায়। আবার একই সময়ে বাজারও মারাত্মক অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে জুনে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয় সরকার। এ সময় আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। তবু আমদানির পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়ায় আগস্টে চালের শুল্ক আরো কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু বারবার শুল্ক কমানোর পরেও পর্যাপ্ত মাত্রায় চাল আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে।

দেশের বাজারে চালের দাম কমাতে চলতি বছর প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এজন্য ৩২৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শুল্কছাড়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তবে কয়েক দফায় শুল্ক কমানোর পর ঋণপত্র খুললেও চাল আমদানি করছে না বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট চাল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৫৪ হাজার টন। আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন। সে হিসেবে চলতি বছর শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত আমদানির চাহিদা পূরণের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ।

দেশে চাহিদা অনুপাতে মজুদ না থাকলেও আমদানির অনুমতি নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর চাল আমদানির পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, একসময় চাল আমদানির জন্য কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। গত কয়েক বছর সরকার আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী অনুমোদন দিচ্ছে। চাল আমদানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এটি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের মজুদ রয়েছে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৫২ টন। এছাড়া ধান মজুদ রয়েছে ৭৬২ টন। মন্থরগতিতে চলছে সরকারিভাবে আমন মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমও। এ কার্যক্রম শুরু হয় গত ১০ নভেম্বর। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৯ দিন পেরোলেও এ সময় পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩০০ টন। আর চাল সংগ্রহ হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৯ টন। যদিও চলতি আমন মৌসুমে সরকারিভাবে তিন লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল সরকার।

এ বিষয়ে কৃষকদের ভাষ্য হলো খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া দাম বাজারমূল্যের চেয়ে কম। সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে প্রক্রিয়াগত জটিলতাও অনেক। এজন্য তারা বাজারে ধান বিক্রিতেই বেশি আগ্রহী। আবার মিলাররাও চাল সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হতে আগ্রহী নয়। ফলে এবারো লক্ষ্য অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ হবে না বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের।

এমন পরিস্থিতিতে বহিঃস্থ উৎস থেকেও চাল আমদানির প্রয়াস চালাচ্ছে সরকার। গত সপ্তাহেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দেশটি থেকে পণ্য আমদানিতে বার্ষিক কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ। এ সময় খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ভারতের পক্ষ থেকে কোটা সুবিধা চাওয়া হয়। দেশটি এতে সম্মতিও দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে ডলারের পরিবর্তে রুপিতে বাণিজ্য পরিচালনার অনুরোধ করা হয়।

আবার কিছুদিন আগেই ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক এক দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ। এ দরপত্র জমা দেয়ার সর্বশেষ সময় ছিল ২১ ডিসেম্বর। ধারণা করা হচ্ছে, সর্বনিম্ন মূল্যের দরপত্র জমা দানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছত্তিশগড়ভিত্তিক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বাগাদিয়া ব্রাদার্স এ পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবিত দর অনুযায়ী, প্রতি টন চালের দাম পড়বে ৩৯৩ ডলার ১৯ সেন্ট (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ৪০ হাজার টাকার কিছু বেশি)। পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘কোন দেশে কী হারে চালের দাম বেড়েছে, এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। তবে দেশের বাজারে বর্তমানে চালের দাম কমছে। সামনে আরো কিছুটা কমবে। সরকারিভাবে চাল আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে বেসরকারিভাবে কিছুটা কম আমদানি হলেও তা আশা করছি পূরণ হয়ে যাবে। দেশে চালের মজুদ এখন পর্যাপ্ত।’

টিসিবির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে খোলাবাজারে মোটা চালের দাম কিছুটা কমে প্রতি কেজি ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সরু মিনিকেট চাল ৭৫ ও মাঝারি চাল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।




  এ বিভাগের অন্যান্য