ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা এবং এদের প্রায় ৫০০ শাখা-প্রশাখা দিয়ে পানির সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ১ দশমিক শূন্য থেকে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন মাটিকণা প্রবাহিত হয়। হিমালয়ের এ বিশাল পলিমাটির দুই-তৃতীয়াংশ চলে যায় বঙ্গোপসাগরে। বাকি এক ভাগ নদীর বুকে জমা হয়ে প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর চর সৃষ্টি করেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, হিমালয়ের পলি মাটি জমা হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ১৯ বর্গকিলোমিটার করে আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিমালয় থেকে প্রবাহিত মাটির মধ্যে থাকে বালুকণা, পলিকণা ও কাদা মাটির কণা। বালুকণা আকারে বড় ও ভারী হওয়ায় প্রথমেই দেশের উত্তরাঞ্চলের চরে তা জমা হয়, পলিকণা বালুকণার চেয়ে ছোট ও হালকা কিন্তু কাদাকণার চেয়ে বড় ও ভারী বিধায় দেশের মধ্য অঞ্চলের চরে জমা হয় এবং পলিকণা সবচেয়ে ছোট ও হালকার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চরে জমা হয়ে থাকে। ফলে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের চরে বালির পরিমাণ বেশি থাকে।
দেশে উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের চরে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়। এ বছরও বন্যায় চরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিমগ্ন হওয়ায় আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। চর এলাকার ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান এবং বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন, উভয়ই বন্যার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। The Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর পঞ্চম মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের বর্তমান মাত্রা কমানো না গেলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আগামী ২১০০ সালে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ৩ দশমিক ৭-৪ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। এতে গ্রীষ্মকালে উচ্চতাপমাত্রার দিনের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং শীতকালের দিনের সংখ্যা কমে যাবে। ফলে দিনপ্রতি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে অথচ বৃষ্টির দিনের সংখ্যা কমে যাবে। অর্থাৎ বর্ষাকালে দিনপ্রতি বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং বছরের অন্য সময়ে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা কমে যাবে। ফলে বাংলাদেশে বর্ষাকালে বন্যার প্রকোপ বাড়তেই থাকবে এবং চর এলাকা হবে তার প্রধান টার্গেট।
দেখা যায়, যে এলাকায় প্রধান নদীর সঙ্গে বেশি সংখ্যক শাখা-প্রশাখা নদী যুক্ত হয়েছে সেসব এলাকায়ই বন্যার প্রকোপ বেশি হয়। যেমন কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা এলাকায় প্রতি বছর বন্যার কারণ হলো সেখানে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ প্রায় ২২টি শাখা-প্রশাখা নদী ব্রহ্মপুত্র-যমুনার সঙ্গে মিশেছে কিংবা বৃহত্তর ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর এবং এর আশপাশের এলাকায় বন্যার কারণ হচ্ছে পদ্মা-যমুনা-মেঘনা এবং এদের শাখা-প্রশাখার ব্যাপক জলরাশি মেঘনা নদী দিয়ে যে গতিতে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হওয়া প্রয়োজন, তা না হওয়া। প্রতি বছর বন্যা হলেও বন্যার সময়ের ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ। আবার বন্যার সময় ও এর মাত্রা নির্ভর করে হিমালয়ে বৃষ্টির সময় এবং পরিমাণের ওপর। জলবায়ুর পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলাদেশের বন্যার গতিপ্রকৃতির ওপর দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে।
চরে প্রতি বছর বন্যা হবে—এটাই স্বাভাবিক। এটা চরের কৃষকের জীবনের অংশ, কিন্তু বন্যার মাত্রা বেশি হলে কিংবা এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে কৃষককে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষকের সবচেয়ে অসুবিধা হয় গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘর ভেঙে যায়, গো-খাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে এবং পশুর অসুখ-বিসুখ বেড়ে যায়। দুর্গম এলাকায় চরের অবস্থান হওয়ার কারণে গরু-ছাগল চুরি বা ডাকাতির মাত্রাও বেড়ে যায়। অনেক সময়ই মানুষ ও পশুকে একই ঘরে বসবাস করতে হয়। সংরক্ষণাগার না থাকায় বন্যায় ফসলের বীজ নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষাকালের প্রধান ফসল আমন ধান নষ্ট হয়। তবে আমন ধানের ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে বন্যার স্থায়িত্ব, বন্যার পানির গভীরতা, ধানের জাত ও গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ের ওপর। চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যে ধানের চারা সম্পূর্ণ ডুবে গেলে এবং বন্যার স্থায়িত্ব যদি দুই সপ্তাহের বেশি হয়, তাহলে আমন ধান রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
দেখা গেছে, যে বছর বন্যার প্রকোপ বেশি হয় সে বছর রবি মৌসুমের ফসলের ফলন ভালো হয়। এর কারণ হলো বন্যার মাত্রা বেশি হলে হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এসব পলিতে গাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্যোপাদান থাকে। তাছাড়া বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয় সেসব জমিতে কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য যেমন গম, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে পারে।
অনেক বছর আগস্টের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় না। এ রূপ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন—বিইউ ধান১, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, বিনা ধান-৭ চাষ করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বা বিএডিসিকে চারা সরবরাহে মূল ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষক পর্যায়েও ধানের চারা উৎপাদন সম্ভব। যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে ওই বছর নতুনভাবে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন ব্যাপক মাত্রায় কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না।
যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝির আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ অর্থাৎ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় দুই-তিনটি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তাহলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং মূল জমির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধান কাটা যাবে। এতে কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। যদি বন্যার পানি সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের পরও স্থায়ী হয় তাহলে এসব জমিতে কোনোক্রমেই দ্বিতীয়বার আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না, বরং অন্তর্বর্তীকালীন গরুর ঘাস হিসেবে মাষকলাই কিংবা পাতা জাতীয় স্বল্পমেয়াদি জাতের সবজি চাষ করা যেতে পারে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমি অবশ্যই সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথমেই রবি ফসল, যেমন—গম, ভুট্টা, আলু, ডালজাতীয় ফসল ইত্যাদি চাষ করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে।
গত বছর পরপর দুবার প্রায় এক মাস স্থায়ী বন্যায় উত্তরাঞ্চলের চরের আমন ফসল প্রায় নষ্ট হয়েছিল। যে বছর বন্যায় অমন ধান নষ্ট হয় সে বছর চর এলাকায় রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এ সময়ে কৃষককে রবি ফসল, বিশেষ করে গম, ভুট্টা, সরিষা, আলু বা ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। চরের কৃষির ওপর ভর্তুকি দেয়া হলে তা হবে সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। কারণ চরের ফসল জাতীয় কৃষি উৎপাদনে এক বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গম চরে কাজ করতে আগ্রহী হন না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে চরের কৃষক বঞ্চিত হন বা বিলম্বে তা জানতে পারেন। এর মূল কারণ অত্যন্ত নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থা। মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা পর্যাপ্ত পরিমাণ যাতায়াত ভাতা পান না। চরে যারা কাজ করবেন তাদের হিল অ্যালাউন্সের মতো চর অ্যালাউন্সের প্রবর্তন করে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, চরের কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। কারণ উঁচু ও ভালো কৃষিজমি প্রতি বছর প্রায় শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। কিন্তু চরে জমির পরিমাণ ফি-বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। চরকে এজন্যই বলা হয় ‘কৃষির হিডেন ডায়মন্ড’। কারণ প্রায় এক মিলিয়ন চরই হলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের খাদ্যের আধার।
যেহেতু চরে প্রতি বছর বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে, সেহেতু চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। দেখা যায় দুর্গম চরে আধুনিক কৃষির তথ্য অনেক বিলম্বে পৌঁছে। কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ চর এলাকায় এখনো সোনালিকা জাতের গম চাষ করা হয়, যা কৃষিবিজ্ঞানীরা বহু আগ থেকেই চাষ করার জন্য নিরুৎসাহিত করছেন। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে গম গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সম্প্রতি অবমুক্ত জাতগুলো যেমন—বারী গম-২৫, ৩০, ৩৩ এরই মধ্যে জনপ্রিয়ভাবে চাষ হচ্ছে। চরে রবিশস্য নির্ঝঞ্ঝাট চাষ করা যায়। তবে উত্তরাঞ্চল ও পদ্মার চরের মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি থাকায় মাটির পানির ধারণ ক্ষমতা কম হয়। অন্য এলাকার তুলনায় তাই চর এলাকায় বেশি সেচ প্রয়োজন হয়। আবার চরে বিদ্যুতের সুবিধা না থাকায় ডিজেলের মাধ্যমে সেচ পাম্প চালাতে হয়। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। বন্যায় যেহেতু কৃষকের বীজ নষ্ট হয়ে যায়, সেহেতু কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষক সংগঠন করে বীজ রক্ষণাগার তৈরি করতে হবে। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষককে রবি ফসলের নির্বিঘ্ন চাষের জন্য বীজসহ কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া বন্যার সময় গবাদিপশুর থাকার জন্য উঁচু করে সরকারের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় গোয়ালঘর নির্মাণ করা যেতে পারে। গবাদিপশুর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা না হলে চরের কৃষক উন্নত জাতের গবাদিপশু লালন-পালনে উৎসাহিত হবেন না। চরে খাঁচা/প্যানকালচার পদ্ধতিতে বর্ষাকালে দ্রুতবর্ধনশীল মাছের চাষ করা সম্ভব বলে মাত্স্য বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। তবে সেজন্য কৃষককে প্রশিক্ষণসহ বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। চরের কৃষক মাছের পোনা সহজে পান না। সেজন্য সমন্বিতভাবে চরের কৃষককে সহযোগিতা করতে হবে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে অকৃষিকাজে ব্যবহূত হচ্ছে এবং চরের এলাকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেহেতু ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা বহুলাংশেই চরের কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভর করবে। কাজেই চর কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বাস্তবিক গুরুত্ব দিতে হবে।