www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

কৃষকদের উৎসাহিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিক কৃষি মন্ত্রণালয়

কৃষকদের উৎসাহিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিক কৃষি মন্ত্রণালয়


 এগ্রিবার্তা ডেস্ক    ২১ ডিসেম্বর ২০২২, বুধবার, ১১:১৯   সম্পাদকীয় বিভাগ


বাংলাদেশে এমন একটা সময় ছিল যখন ভোজ্যতেলের চাহিদার সবটার জোগান আসত দেশের উৎপাদিত তেল-জাতীয় ফসল থেকে, কিন্তু জানা-অজানা কারণে গত পাঁচ দশকে দেশের সে চিত্র পাল্টে গেছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ তেল শিল্প ধীরে ধীরে হয়ে গেছে আমদানিনির্ভর শিল্পে। সরিষা, সূর্যমুখী, তিল, বাদাম, নারিকেল তেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে সয়াবিন ও পাম জাতীয় তেল। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, দেশের ভোজ্যতেলের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯০ শতাংশই আসে বিদেশ থেকে। চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ হয় দেশে উৎপাদিত ফসল থেকে। ভোজ্যতেল আমদানিতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ভোজ্যতেলের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় আরো বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকার ভোজ্যতেলের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। সরকারপ্রধানও বিভিন্ন ফোরাম ও আলোচনায় বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ভোজ্যতেলের লাগামহীন দাম বৃদ্ধিতে ক্রেতাদের অস্বস্তি বাড়ছে। এক্ষেত্রে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে অবশ্যই সয়াবিন ও পাম অয়েলের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। সে বিকল্প অবশ্যই আমদানিনির্ভর নয় বরং নিজ দেশে উৎপাদিত হতে হবে।

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তেল উৎপাদনকারী দেশের তালিকার শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে দুটি দেশ হলো রাশিয়া ও ইউক্রেন। যুদ্ধের কারণে বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ভোজ্যতেল রফতানি সংকুচিত হয়েছে। সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম হলো ইউক্রেন আর দ্বিতীয় রাশিয়া। ইউক্রেন তার উৎপাদনের ৮৮ শতাংশ রফতানি করে আর রাশিয়া রফতানি করে প্রায় ৮৫ শতাংশ। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাদের রফতানি প্রায় বন্ধ। সরিষা বীজ বা সরিষা তেল উৎপাদনে নেপাল বিশ্বে প্রথম হলেও পরের দুটি দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। এ দুটি দেশ তাদের মোট সরিষা তেল বা বীজ উৎপাদনের প্রায় ৯৩ শতাংই রফতানি করে থাকে। যুদ্ধের কারণে সেটাও বন্ধ। অন্যদিকে পাম তেল বা ভেজিটেবল অয়েল উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম ইন্দোনেশিয়া এবং দ্বিতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া। ইন্দোনেশিয়া তাদের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক রফতানি করে থাকে। মার্চ ২০২২-এর শেষ সপ্তাহে হঠাৎ করে তারা পাম অয়েল রফতানি বন্ধ করে দেয়; পরে অবশ্য অল্প করে রফতানি শুরু করেছে। মালয়েশিয়াও রফতানি বন্ধের পরিকল্পনা করেছিল। বিশ্বে ভোজ্যতেল বিশেষত সয়াবিন উৎপাদনের আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো আর্জেন্টিনা। তারাও তাদের উৎপাদিত তেল রফতানি সীমিত করবে বলে চিন্তাভাবনা করছে। যদি সেটা সত্য হয় তাহলে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট আরো চরম আকার ধারণ করবে। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সরিষার তেল হতে পারে অন্যতম বিকল্প ভোজ্যতেলের উৎস। দেশে সরিষার চাষাবাদ জনপ্রিয় করার জন্য কৃষক পর্যায়ে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ করা গেলে কৃষক একদিকে যেমন লাভবান হতেন, অন্যদিকে সরিষা উৎপাদন বেশি হতো এবং ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমানো যেত। এছাড়া দেশে বহু অটো রাইস মিল রয়েছে। অটো রাইস বার্ন ব্যবহার করেও এক ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেল (রাইস বার্ন অয়েল) উৎপাদন করা যায়। আমদানি তেলের বিকল্প হিসেবে এ ধরনের তেল উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করা যেতে পারে। এছাড়া দেশে প্রচুর সূর্যমুখী চাষাবাদ হয় তা থেকেও তেল উৎপাদন সম্ভব। যেভাবেই হোক ভোজ্যতেলের ওপর থেকে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে।

উন্নত তেলবীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষককে প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা, সহজ শর্তে ঋণ, যাবতীয় উপকরণ সরবরাহসহ অন্য সব সুবিধা নিশ্চিতকরণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো জাতের সরিষা চাষ করতে সময় লাগে মাত্র তিন মাস। সরিষার উৎপাদন খরচও অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম। সরিষা সংরক্ষণে কোনো হিমাগারের প্রয়োজন হয় না। আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাপক সরিষার আবাদ সম্ভব। সরিষা আবাদে অন্যান্য ফসলের মতো সার ও সেচের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু দেশে প্রতিনিয়ত কমছে কৃষিজমির পরিমাণ এবং সে সঙ্গে কমছে তেলবীজের জমির পরিমাণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ, মানুষের রুচি ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনসহ নানা কারণে তেল ফসলের উৎপাদন কমছে। প্রতিদিনের রান্নায় ভোজ্যতেল অপরিহার্য। এছাড়া বিভিন্ন আচার, আয়ুর্বেদী ওষুধ, মোম, সাবানসহ নানা প্রসাধন তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বেকারিতেও রয়েছে এর বহুমুখী ব্যবহার। দেশে বছরে আমনের চাষ হয় ৫৮-৬০ লাখ হেক্টর জমিতে। অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কাটার পর জমি পতিত রাখেন; কিন্তু এ সময়ে যদি সরিষার চাষ করা যায় তবে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সারা বছর সরিষার চাহিদা থাকে এবং ভালো বাজারমূল্যও পাওয়া যায়। এতে কৃষক লাভবান হবেন এবং দেশও উপকৃত হবে। আর এখনই সে সময়।

দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাদের রান্নাবান্না ও দৈনন্দিন ব্যবহারে সরিষার তেল পছন্দ করে এবং দেশে এর উৎপাদনও বেশি পরিমাণে হয়। দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু সরিষা চাষের জন্য উপযোগী। সরিষা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি যেসব জেলায় সরিষা ভালো হয়, সেগুলোয় যাতে সরিষার আবাদ বাড়ানো হয় তার ওপর জোর দিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, নতুন জাত উদ্ভাবন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ও এজন্য মানসম্মত গবেষণা এবং গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এও খেয়াল রাখা দরকার, গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ালে তার সুফল পেতে বেশ কয়েক বছর লাগবে; কিন্তু এখনই শুরু করা না গেলে ভোজ্যতেল আমদানিতে নির্ভরতা দীর্ঘস্থায়ী হবে। দেশে সয়াবিনের উৎপাদন বাড়ানোরও সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সয়াবিন উৎপাদনে প্রযুক্তি সুবিধা সৃষ্টি এবং কৃষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সয়াবিন থেকে তেল উৎপাদন করতে বিশেষায়িত শিল্প স্থাপন করা দরকার। আউশ মৌসুমে তিলের আবাদ ভালো হয়। কৃষক ভাইয়েরা আউশ ধান, আখসহ অনেক ফসলের সঙ্গে তিল আবাদ করেন। রবি মৌসুমে মসুরের সঙ্গে তিসির আবাদ করলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। উন্নত জাতের তেলবীজ উদ্ভাবনের নিমিত্ত জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে নিবিড়ভাবে গবেষণা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের প্রণোদনার প্রয়োজন হলে সেটাও করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে প্রযুক্তি সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা এবং ভর্তুকিদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করতে হবে। সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে অদূর ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে ওই ধরনের শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে এলাকাবিশেষে কোন জমিতে কী ধরনের ফসল ভালো হয়, তা জানা জরুরি। এটি জানা সম্ভব হলে ক্রপ মডেলিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন সম্ভব। পৃথিবীর বহু দেশ যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, নেদারল্যান্ডস, ভিয়েতনামসহ বহু দেশে ক্রপ মডেলিংয়ের ব্যবহার রয়েছে। সব ধরনের তেলবীজ উৎপাদনে উদ্যোগ গ্রহণ করতে এবং পর্যায়ক্রমে আবাদযোগ্য এলাকা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মেটাতে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমটি হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। বর্তমানে আবাদ করা স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উচ্চফলনশীল সরিষার জাত কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অনাবাদি চরাঞ্চল, উপকূলের লবণাক্ত, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলকে তেলজাতীয় ফসল চাষের আওতায় আনা। তৃতীয়ত, নতুন শস্যবিন্যাসে স্বল্প জীবত্কালের ধানের চাষ করে রোপা আমন ও বোরোর মধ্যবর্তী সময়ে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে সরিষার চাষ করা। আগে দেশে উৎপাদন থেকে আসা বাদাম তেল, নারিকেল তেলসহ অন্যান্য তেল ব্যবহার করেই খাবার তৈরি হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বাজার আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দখলে চলে যায়। কিন্তু দেখা গিয়েছে, দেশে উৎপাদিত তেলই বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। এক্ষেত্রে তেলবীজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যেতে হবে। সে সুযোগও রয়েছে, প্রয়োজন কৃষিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও কৃষকের প্রণোদনা নিশ্চিত করা।




  এ বিভাগের অন্যান্য