বশেমুরকৃবির রজতজয়ন্তী
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২৪ বছর খুব দীর্ঘকাল নয়, তবে বশেমুরকৃবি এরই মধ্যে একটি অনন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ স্বল্প সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয় কৃষিতে নতুন জ্ঞান-সৃজন, সৃজিত জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরি এবং সর্বোপরি গবেষণালব্ধ নতুন জ্ঞানের প্রয়োগে কৃষিকে ‘স্মার্ট কৃষি’তে রূপান্তরে দেশে এক অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছে। দেশের উচ্চশিক্ষায় বশেমুরকৃবির অর্জন এবং এটিকে বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নতিকরণের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করাই এ প্রবন্ধের অবতারণা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি এ বছর ২৪ বছর বয়স অতিক্রম করছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যাপনা এবং গবেষণা ১২ বছরের অধিক মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বশেমুরকৃবির যাত্রা ১৯৯৮ সালের ২২ নভেম্বর। এটি পূর্বতন ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (ইপসা)-এর উন্নতিকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ-জাপান-যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ত্রিপক্ষীয় আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ১৯৯১ সাল থেকে দেশে উচ্চতর কৃষিশিক্ষায় স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইপসা এদেশে সর্বপ্রথম ট্রাইমিস্টার (সামার, অটাম এবং উইন্টার টার্ম) নর্থ-আমেরিকান কোর্স ক্রেডিট শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রবর্তন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের পাশাপাশি বশেমুরকৃবিতে বহিরাঙ্গন কার্যক্রম একটি অন্যতম কর্মকাণ্ড, যা ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা বহিরাঙ্গন কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। ল্যাবরেটরি ও মাঠভিত্তিক গবেষণার পাশাপাশি বহিরাঙ্গন কার্যক্রম কৃষক ও গবেষকদের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত গবেষণালব্ধ ফল কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে গবেষণা কর্মশালা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে অবহিত করানো হয়। বহিরাঙ্গন কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার জন্য গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার টোকনগরি এবং সদর উপজেলার কাউলতিয়ায় দুটি ‘প্রযুক্তি ভিলেজ’ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষী ও খামারিদের হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর নিয়মিত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
গত ২৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি সত্যিকারভাবেই ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বশেমুরকৃবিতে বিশেষ করে তরুণ শিক্ষকদের গবেষণায় মনোযোগ খুবই ইতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্পেনভিত্তিক সিমাগো র্যাঙ্কিংয়ে পরপর দুবার দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে। সিমাগো রেংকিংয়ে স্কুপাস ইনডেক্সিং জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা এবং বিশ্বজ্ঞানভাণ্ডারে-ইম্প্যাক্টফুল গবেষণা প্রবন্ধ সংখ্যাকে বিবেচনা করা হয়। গত কয়েক বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সহস্রাধিক প্রবন্ধ স্কুপাস ইনডেক্সিং জার্নালে প্রকাশ করেছে, এবং প্রতি বছরই এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুপাস ডাটাবেজ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী পাঁচ বা তদূর্ধ্ব ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরবিশিষ্ট বিশ্বখ্যাত জার্নালে তিন শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। উল্লিখিত তিন শতাধিক উচ্চমানের প্রকাশনার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রকাশিত করেছে ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (আইবিজিই) ছাত্র এবং শিক্ষকরা। এ ইনস্টিটিউটটি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চালিকাশক্তি, ন্যানোটেকনোলজি, জিনোমিক্স, বায়োইনফরমেটিক্স, জিনোম এডিটিং এবং মেশিন লার্নিং, বায়োটেকনোলজিসহ অন্যান্য অগ্রসরমান প্রযুক্তি দ্বারা দেশের চাহিদাভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করে থাকে।
বশেমুরকৃবির আইবিজিই দেশে গমের মহামারী ব্লাস্ট রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের জিনোম বিশ্লেষণ করে রোগটির কৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং উত্পত্তিস্থল নিরূপণের গবেষকদলের নেতৃত্ব দেন। তাদের আবিষ্কারের ফলে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হয়, যা পরবর্তী বছরগুলোয় মহামারী প্রতিরোধ করে। আইবিজিইর বিজ্ঞানীরা ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনে ক্রিসপার-ক্যাস জিনোম সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহারে গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত উন্নয়নে কাজ করেছে। তারা জিনোম-নির্দিষ্ট প্রাইমার এবং ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে গমের ব্লাস্ট ছত্রাক নির্ণয়ের জন্য একটি দ্রুত (মাত্র ৩০ মিনিটে) এবং পয়েন্ট-অব-কেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। আইবিজিই প্রথমবারের মতো দিনের আলোচালিত রিচার্জেবল একটি ন্যানো-ছত্রাকনাশক তৈরি করেছে, যা কার্যকরভাবে ধ্বংসাত্মক গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । তারা প্রোবায়োটিক সার আবিষ্কার করেছে, যা ধান এবং অন্যান্য ফসলে ৫০ শতাংশ রাসায়নিক সারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত ইলুমিনা সিকোয়েন্সিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আইবিজিইর বিজ্ঞানীরা বারোমাসি কাঁঠালের জীবন-রহস্য উন্মোচন করেছেন। বারোমাসি কাঁঠালের পূর্ণাঙ্গ জীবন-রহস্য উন্মোচিত হওয়ায়, জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে নানা স্বাদের এবং বৈশিষ্ট্যের নতুন কাঁঠালের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হবে, যা দেশে কাঁঠালের বাণিজ্যিক চাষাবাদ এবং প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশে সহায়ক হবে। প্রতি বছর আইবিজিই থেকে বিশ্বের নামকরা জার্নাল এবং পুস্তকে কমপক্ষে ৫০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে, যা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয়। বশেমুরকৃবির সিমাগো র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম হওয়ার ক্ষেত্রে আইবিজিইর উচ্চ ইম্প্যাক্টবিশিষ্ট প্রকাশনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। উল্লেখ্য, আইবিজিইতে জেনেটিক্স মলিকুলার বায়োলজি এবং জীবপ্রযুক্তি গবেষণায় শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী রয়েছে, যিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিখ্যাত এলসেভিয়ারের র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর একজন। অত্যন্ত অল্প কয়েক বছরে আইবিজিই বিশ্বব্যাপী গবেষণায় ও উৎকর্ষে সুপরিচিতি লাভ করছে। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা যৌথ প্রকল্পে কাজ করছেন। আইবিজিই থেকে এরই মধ্যে শতাধিক পোস্টডক, পিএইচডি, মাস্টার্স ও স্নাতক পর্যায়ের গবেষক তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে দেশে এবং বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে গবেষণা করে চলেছেন।
বশেমুরকৃবি মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার সমন্বয়ে এ পর্যন্ত ধানসহ বিভিন্ন অর্থকরী ফসল, সবজি ও তেলজাতীয় ফসলের ৬৭টি উচ্চফলনশীল জাত ও ১৪টি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক চালু করা এপিএতেও বশেমুরকৃবি পেয়েছে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা। মৌলিক গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি সর্বোত্কৃষ্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্যাটাগরিতে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পুরস্কার অর্জন করে। ২০১৫ সালে বৃক্ষরোপণ ও কৃষি বনায়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০১৪ অর্জন, ২০১৭ সালে শিক্ষা, গবেষণা ও বহিরাঙ্গন কার্যক্রমে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২২ (স্বর্ণ) অর্জন। ব্যক্তিগত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক, ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট পদক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো, বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো, আমেরিকান ফাইটোপ্যাথলজিক্যাল সোসাইটির ফেলো, ইউজিসি অধ্যাপক ইত্যাদি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ এদেশে সত্যিই অনন্য। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রদান এবং গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন সব ক্ষেত্রেই পূর্বনির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চলে। শিক্ষক কিংবা ছাত্রছাত্রী সবাই কঠোরভাবে একাডেমিক ক্যালেন্ডার মেনে চলেন। তত্কালীন ইপসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত সর্বমোট ৪ হাজার ৪৯৫ জন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করেছে, এর মধ্যে ১ হাজার ৮৫৪ জন বিএস, ২ হাজার ৩০৫ জন এমএস এবং ৩৩৬ জন পিএইচডি প্রদান করেছে। মোট ৯৮ ছাত্রছাত্রীকে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন রুরাল ডেভেলপমেন্ট সনদ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষিক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০০১ সালের ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স প্রদান করা হয়েছে।
বশেমুরকৃবি নানাভাবে উৎকর্ষ লাভ করলেও পিএইচডি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা (মাত্র ২৫ জন) দ্রুত কমে যাচ্ছে। ইপসা থেকে শুরু করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে পিএইচডি প্রোগ্রাম। ইপসা ছিল কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আওতায় একটি বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ওই সময়ে ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল সিস্টেমের সব প্রতিষ্ঠান থেকে ডেপুটেশনে বিজ্ঞানীরা এখানে পিএইচডি করতে আসত। তখন ভর্তির প্রথম শর্ত ছিল প্রার্থীকে অবশ্যই চাকরিরত হতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় এ শর্তটি থাকায় অনেক মেধাবী মাস্টার্স পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারছেন না। পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে প্রার্থীকে অবশ্যই চাকরিরত হতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। ভর্তির ক্ষেত্রে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েটদের আকৃষ্ট করার জন্য বশেমুরকৃবির এমএস, পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির প্রাক-যোগ্যতায় উন্নত বিশ্বের মতো প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা যেতে পারে।
ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার হিসেবে দীর্ঘকাল যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি রাজ্যের নানা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, শিক্ষা, গবেষণা এবং শিল্পোন্নয়নে ব্যক্তির উৎকর্ষ, উদ্ভাবন এবং নিবেদিত হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হচ্ছে প্রাপ্য স্বীকৃতি, প্রণোদনা এবং যথাস্থানে পদায়ন। বশেমুরকৃবিকে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে চাই এসব নিয়ামকের প্রচলন এবং চর্চা। যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষায় নিবেদিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি টার্মেই ফলের ভিত্তিতে ডিনস লিস্ট, প্রেসিডেন্ট লিস্ট এবং চূড়ান্ত ফলে নানারকম সম্মাননা যেমন সুম্মা কুমলাউড প্রদান করা হয়। তবে বশেমুরকৃবির গ্র্যাজুয়েটদের সর্বোত্তম ফলের জন্য স্বর্ণপদক কিংবা উল্লেখযোগ্য কোনো স্বীকৃতিদানের প্রচলন এখনো কেন শুরু হয়নি। অথচ দেশের প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোত্কৃষ্ট ফলধারীদের সমাবর্তনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বর্ণপদক, চ্যান্সেলর পুরস্কার এবং অন্যান্য অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। নর্থ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার পাশাপাশি নানারকম ক্লাব, প্রজেক্ট ওয়ার্ক এবং ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে প্রকৃত জীবন সংগ্রামে যোগ্য করে তোলা হয়। ফলে চার বছরের স্নাতক শেষ করার পরপরই অধিকাংশ ডিগ্রিধারী স্নাতকোত্তর পর্যায়ে না গিয়ে সরাসরি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। বশেমুরকৃবিতেও এ ধরনের চর্চা আশু প্রয়োজন।
বশেমুরকৃবিতে দেশের চাহিদাভিত্তিক মৌলিক এবং প্রায়োগিক গবেষণায় উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাদানের লক্ষ্যে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের স্বীকৃতি (বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার, চ্যান্সেলর পুরস্কার) ও আর্থিক প্রণোদনার প্রচলন করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকগণকে বিশ্ব পর্যায়ে মতবিনিময়, কোলাবরেশন এবং নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন/সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে কৃষিতে অগ্রসরমান প্রযুক্তির প্রয়োগ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে কৃষি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অথবা ক্লাইমেট স্মার্ট-কৃষি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
বশেমুকৃবির শিক্ষা ব্যবস্থায় এমএস এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম এদেশে অনন্য এবং নর্থ আমেরিকার সঙ্গে তুলনীয়। ইপসাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাপানের কিউসু বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি সহায়তায় এবং জাইকা ও ইউএসএইডের অর্থায়নে এ প্রোগ্রাম দুটি সফলভাবে প্রচলন করা হয়। সুতরাং প্রোগ্রাম দুটি পুরোপুরি নর্থ আমেরিকান কোর্স ক্রেডিট সিস্টেমে চলছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চালুকৃত বিএস প্রোগ্রামগুলো পুরোপুরি নর্থ-আমেরিকান কোর্স-ক্রেডিটের মতো হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মতো বিএস প্রোগ্রামেও মেজর, মাইনর, ইলেক্টিভ কোর্সের সমন্বয়ে এমনভাবে পরিমার্জন করা প্রয়োজন, যেন ছাত্রছাত্রীরা সব ফিক্সড কোর্স নয় বরং নিজেদের পছন্দ মোতাবেক কিছু কোর্স বাছাইয়ের সুযোগ পায়। প্রকৃতপক্ষে নর্থ-আমেরিকান কোর্স-ক্রেডিট সিস্টেমে কিন্তু তিনটি টার্ম সমানভাবে কার্যকর নয়। সামার টার্মে, ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত কোনো কোর্স না নিয়ে ইন্টার্ন হিসেবে এবং অন্যান্যভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে। বশেমুরকৃবিতে স্টুডেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমসহ ছাত্রভর্তি, কোর্স রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষার ফল প্রস্তুতকরণ ও প্রকাশে সর্বোচ্চ ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রচলন আশু প্রয়োজন। উদ্ভাবন এবং গতিশীলতা আনয়নে প্রশাসনিক পদে একই ব্যক্তিকে পুনঃ পুনঃ একই পদে নিয়োগ না দিয়ে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষকগণকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে।
বশেমুরকৃবিতে আইবিজিইর সাফল্য বিবেচনায় রেখে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনবল এবং দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা ও গবেষণার পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, করোনা মহামারীকালেও একদিনের জন্যও আইবিজিইর গবেষণাগারগুলো বন্ধ থাকেনি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান সৃজনে পিছিয়ে থাকা নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক গবেষণা হতে হবে। সেসব গবেষণা প্রকাশের ব্যবস্থাও করতে হবে। গবেষণা হোক। এজন্য অর্থ কোনো সমস্যা নয়। প্রয়োজনে আমি নিজেই টাকার ব্যবস্থা করব।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের গবেষণার মূল অনুপ্রেরণার উৎস হচ্ছে, গবেষণার মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকায়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, জনগণের আর্থসামাজিক উত্তরণের মাধ্যমে একটি দারিদ্র এবং ক্ষুধামুক্ত সমৃদ্ধ জাতি প্রতিষ্ঠা।’ কৃষিতে আরো একটি সবুজ বিপ্লব ব্যতিরেকে এ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য ভূমিকা প্রত্যাশিত। মেধা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির আদলে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় উৎকর্ষের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে বলে আশা করা যায়।
আমেরিকান কোর্স-ক্রেডিট সিস্টেমে পরিচালিত একমাত্র এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বশেমুরকৃবিকে এশিয়ায় কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে—(১) একটি স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন। (২) সব ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা। (৩) দেশের চাহিদামাফিক জ্ঞান-সৃজন এবং জ্ঞানের প্রয়োগে অগ্রসরমান প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তা কৃষকের মাঠে প্রয়োগে সরকারি এবং বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পার্টনারশিপ প্রতিষ্ঠা করা। (৪) শিক্ষকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ এবং উৎকর্ষের জন্য যথার্থ স্বীকৃতি ও প্রণোদনা প্রদান। (৫) নিয়মিত পাঠক্রমের হালনাগাদ এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রায়োগিক শিক্ষার স্বীকৃতিস্বরূপ নানা রকম পুরস্কার/স্বীকৃতির প্রচলন করা। (৬) জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামর্থ্য এবং প্রভাব বৃদ্ধি করা। (৭) পিএইচডি এবং পোস্টডক্টরাল গবেষণাকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে বুয়েটের মতো আকর্ষণীয় ফেলোশিপ প্রবর্তন এবং বিদেশী গবেষকদেরও আকৃষ্ট করা। (৮) এমএস এবং পিএইচডি ভর্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। (৯) বিশ্ববিদ্যালয়ের খামারগুলোয় ছাত্রদের কাজ করার সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে আগামী দিনের উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। খামারগুলো থেকে প্রডাক্ট তৈরি করতে হবে। (১০) শিক্ষকদের শিক্ষা ছুটি, প্রমোশন, সেমিনার-সিম্পজিয়ামে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। (১১) মাস্টার্স এবং পিএইচডি সুপারভাইজর কমিটিতে বিদেশী কোনো অধ্যাপক বা বিজ্ঞানী রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কোলাবোরেশনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও উচ্চশিক্ষার পথ সৃষ্টি হয়। (১২) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক পর্যায়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ই-মেইল আইডি দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে শিক্ষাথীরা বহির্বিশ্বে গবেষণা ও পড়াশোনার জন্য যোগাযোগ সহজ হবে। (১৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন যেমন বিজ্ঞান ক্লাব, বিজ্ঞান সোসাইটি, জার্নাল ক্লাব ইত্যাদি চালু করা প্রয়োজন। (১৪) সেমিস্টার শেষে বিজ্ঞানে কীভাবে ক্যারিয়ার গঠন করা যায়, এ রকম অনেক ওয়ার্কশপ যেমন সায়েন্স কমিনিকেশন, সায়েন্টিক জার্নাল ও থিসিস রাইটিং ছাড়াও বিজ্ঞানের নিত্যনতুন বিষয়ের ওপর সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা।