পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি বৃহত্তম বদ্বীপ। এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা শত শত নদ-নদীর অজস্র ধারায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অনুকূল জলবায়ু ও নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা যেমন কৃষি ও জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই করেছে মৎস্য সম্পদকে।
কৃষি খাতের অন্যতম উপখাত হিসেবে এ দেশের মৎস্য খাতে আশাতীত সাফল্য অর্জিত হয়েছে। গত ২০২০-২১ শত বছর প্রায় ৪৬ দশমিক ২১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে (সূত্র: মৎস্য অধিদপ্তর ২০২২) এ দেশ পৃথিবীর অন্যতম সেরা মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের মানুষ মৎস্য সম্পদের অগ্রগতির এ ধারা অব্যাহত রেখে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা জোগান দেওয়ার জন্য এর বিশাল সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই আহরণের স্বপ্ন দেখছে। সরকারি উদ্যোগে ২০১৪ সালে গৃহীত ব্লু ইকোনমির স্বপ্ন এখন জাতীয় স্বপ্ন হিসেবে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে মৎস্য সম্পদের অধিকতর উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।
অ্যাকোয়াকালচার বা মৎস্য চাষ এ দেশের মানুষ আত্মস্থ করতে সমর্থ হয়েছে। গবেষণালব্ধ নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে মাছ চাষের কলাকৌশল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। গত বছর বাংলাদেশ ২৬ দশমিক ৩৮ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করেছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এ সাফল্য ধরে রাখতে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে আরও উন্নত কলাকৌশল, যেমন পুকুর ও খামার ব্যবস্থাপনায় যান্ত্রিকীকরণে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্পমূল্যে দেশীয় উপাদানে তৈরি মানসম্পন্ন খাবার, মৎস্য রোগ প্রতিকার, পুকুর/খামারের পানি ব্যবস্থাপনাসহ উন্নত ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল (বেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্র্যাক্টটিস) প্রয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইপিআরএস, বায়োফ্লক ও আরএএস প্রযুক্তির সফল ব্যবহার এবং এর সঙ্গে সৌরশক্তির সংযোজন টেকসই মৎস্য চাষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ি চাষ প্রায় ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন সত্ত্বেও বাগদা, গলদা চিংড়ি বা কাঁকড়া চাষে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। গুণমানসম্পন্ন পোনার অভাব, নানা ধরনের রোগবালাইয়ের নিত্য উপস্থিতিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে এ দেশে জনসম্পৃক্ত ক্লাস্টার ফার্মপদ্ধতি উদ্ভাবন কিছুটা স্বস্তিদায়ক ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। গলদা চাষে আমাদের সমন্বিত ঘের চাষপদ্ধতি বহু দেশে অনুকরণ করা হচ্ছে, যা জ্ঞানপিপাসুদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। চিংড়িক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হলে তা অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সফলতা আনতে সক্ষম। উল্লেখ্য যে অল্প ঘনত্বে, পরিষ্কার পানিতে চাষ করা দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বাগদা চিংড়ির পুষ্টিমান ও স্বাদ সম্পর্কে বিদেশি ক্রেতা ও ভোক্তাদের বিশেষ আগ্রহ আছে। চিংড়ি পুকুরের আয়তন কমিয়ে আনা, পানির গভীরতা বৃদ্ধি করা, রোগমুক্ত পোনা মজুত করা এবং যথাযথভাবে জৈব নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হলে বাগদা চিংড়িকে ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘প্রিমিয়াম ন্যাচারাল ব্ল্যাক টাইগার’ হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে বাজারজাত করা যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের নদ-নদীর ইলিশ মাছ উৎপাদনে আমাদের সাফল্য বিশ্বপরিমণ্ডলে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। জনসম্পৃক্ত সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের টেকসই উৎপাদন ছয় লাখ টনে উন্নীত করা এখন আর কঠিন বিষয় নয়। শুধু প্রজননকালে মা ইলিশ রক্ষা এবং পরবর্তী সময়ে জাটকা রক্ষা করে গেলে এ দেশে ইলিশ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। নদ-নদীগুলো দূষণমুক্ত ও এসবের মোহনার চর অপসারণ করে মাছের নির্বিঘ্ন চলাচল অব্যাহত রাখতে হবে।
দেশের হাওর-বাঁওড় ও বিলগুলো মাছের জীববৈচিত্র্যের সূতিকাগার। নানাবিধ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে এসব জলাশয়ের মাছের উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। এদের প্রজননের জন্য মে-জুন—দুই মাস এসব জলাশয়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখা যেতে পারে। সেই সঙ্গে উপযুক্ত স্থানে হ্যাচারিসহ একটি হাওর গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে প্রায়োগিক গবেষণাসহ বিলুপ্ত প্রায় মাছের পোনা তৈরি করে মজুত করা গেলে হাওরগুলো আবার মাছে ভরে উঠতে পারে। আবাসস্থলগুলোর উন্নয়ন, মাছের গতিপথ উন্মুক্তকরণসহ জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারলে এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হতে পারে।
বিগত কয়েক বছর কোভিড-১৯–এর অভিঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতিতে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও মিথেন গ্যাসের অতিরিক্ত বৃদ্ধি বিশ্বপ্রকৃতির বিপর্যয়সহ মানবকুলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা আজ হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থায় ভূভাগের ওপর কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের চাপ কমিয়ে বিশাল সামুদ্রিক জলরাশিকে চাষ ও ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা আজ সময়ের দাবি। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে এর পরিসর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর ৬ দশমিক ৮১ লাখ মেট্রিক টন মাছ আহরণের মধ্য দিয়ে মৎস্য সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এ উৎপাদনের ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ এসেছে আর্টিসানাল মৎস্য আহরণ থেকে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সম্পদের সঠিক ডেটা সংগ্রহের সম্ভব হলে এ উৎপাদন ১০ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে। ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞার ফলে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন বৃদ্ধি ও বিলুপ্ত প্রায়। মৎস্য প্রজাতির পুনরায় উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে নিষিদ্ধকাল পুনর্নির্ধারণ করে ১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত করা সম্ভব হলে জাটকা রক্ষা কার্যক্রম আরও সফল হতে পারে। এতে পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরা নিষিদ্ধকালের সঙ্গে অনেকটা মিল রাখা সম্ভব হবে। সঙ্গে সঙ্গে গভীর সমুদ্র থেকে টুনাসহ বড় মাছ আহরণের মাধ্যমে আমাদের নিরঙ্কুশ অধিকার নিশ্চিতসহ ব্লু ইকোনমি সুফল ঘরে তোলার এখনই সময়। তবে লক্ষ রাখতে হবে, দ্রুত অতি আহরণের মাধ্যমে আমাদের সাগর যেন মৎস্য শূন্য না হয়ে যায়।
সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি সমুদ্রে মৎস্য চাষ বা মেরিকালচারকে ব্লু ইকোনমির একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোরাল, গ্রুপার, রেড স্নাইপার ও রুপচাঁদার মতো মাছের প্রজননে সফলতা অর্জন করে সামুদ্রিক মাছ চাষে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। সামুদ্রিক শৈবাল বা ‘সি উইডস’ চাষ আরও একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে সারা বিশ্বে বিবেচিত হচ্ছে। জেলে সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে ব্যাপক ভিত্তিতে এর চাষ করে মানুষের খাবার, প্রসাধনী, প্রাণী ও মাছের খাবার, জৈব সার হিসেবে ব্যবহারসহ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
বর্তমানে আহরিত সামুদ্রিক মাছের বিরাট একটি অংশ ছোট জাতের মাছ। এগুলো খুবই পুষ্টিকর। তাই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে এ মাছগুলো শুকিয়ে মাছের পাউডার তৈরি করা ও আরও বিবিধভাবে প্রক্রিয়াজাত করে দেশের মানুষের পুষ্টির উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে। জেলেবধূদের এ কাজে সম্পৃক্ত করে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যেতে পারে।
সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশে মৎস্য সেক্টর বিপুল সম্ভাবনা উন্মোচনে পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে ক্রমবর্ধমান সাফল্য, ইলিশসহ নদীর মাছের আহরণ বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে দেশের শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মৎস্য চাষে উদ্যোগী হওয়ার আগ্রহ, মৎস্য সেক্টরের গতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে। অদূর ভবিষ্যতে লোনাপানিতে মাছের চাষ বাড়ানোর সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সাগরকেন্দ্রিক ব্লু ইকোনমির হাতছানি দেশের খাদ্য–পুষ্টির নিরাপত্তাসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রাখবে বলে আমরা আস্থা রাখতে পারি। সে লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।