www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

জীবনরহস্য উন্মোচন

প্রথম জাত হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে চট্টগ্রামের লাল গরু


 এগ্রিবার্তা ডেস্ক    ১৯ অক্টোবর ২০২২, বুধবার, ৭:৫৫   ডেইরী বিভাগ


রেড চিটাগং ক্যাটল (আরসিসি), মুন্সীগঞ্জ ক্যাটল, পাবনা ক্যাটল ও নর্থ বেঙ্গল গ্রে উচ্চ উৎপাদনশীল দেশী গরুর জাত হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। তবে দেশে এ পর্যন্ত গবাদিপশুর কোনো জাতই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। এবার আশা দেখাচ্ছে আরসিসি বা চট্টগ্রামের লাল গরু। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) একদল গবেষক জাতটির জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। এছাড়া স্বীকৃতি পেতে অতিক্রম করা হয়েছে সব ধাপ। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা শেষে জাত ও জাতবিষয়ক জাতীয় কারিগরি নিয়ন্ত্রণ কমিটিও (এনটিআরসি) রেড চিটাগং ক্যাটলকে নতুন জাত হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয়ভাবে চট্টগ্রামের লাল গরু নামে পরিচিত আরসিসি জাতের গরু নব্বই দশকের দিকেও সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও পটিয়া অঞ্চলে পাওয়া যেত। মাংসের পাশাপাশি এ জাতের গাভীর দুধও বেশ পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। প্রায় প্রতি বছরই প্রজননে সক্ষম। সে সময় গরুগুলো ৪০০-৫০০ কেজি পর্যন্ত বড় হতো। আর প্রতি গাভী থেকে দৈনিক দুধ মিলত ৪-৫ লিটার। কিন্তু জাতটি সংরক্ষণ না করায় কৃত্রিম সংকরায়নের কারণে এ গরুর উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করে। এরপর কয়েক ধাপে বাকৃবি, বিএলআরআই ও বিভিন্ন সংস্থা আরসিসি গরু সংরক্ষণে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়। দীর্ঘ গবেষণা শেষে উন্মোচন করা হয় এর জীবনরহস্য। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরসিসির জীবনরহস্য উন্মোচন ও জাত স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে দেশীয় জাতের গরুর সম্প্রসারণে এক নতুন দ্বার উন্মোচন হবে।

স্থানীয় এ জাতের গরুর সংখ্যা নিয়ে যথাযথ কোনো তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে রেড চিটাগং ক্যাটলের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৪৮৯। ২০২১ সালে ফ্রন্টিয়ার্স নামের সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জার্নালে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে আরসিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৭৩০। এ সময় শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ গরু পাওয়া গেলেও এরপর সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। বাকৃবির আরেক জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালে সারা দেশে আরসিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৬০০।

বিনিয়োগ ও লাভ হিসেবে দেশীয় এ জাত সংকর জাতের চেয়েও লাভজনক। মাংস ও দুধ উৎপাদন কম হলেও অনুকূল আবহাওয়া, খাদ্য খরচ, প্রজনন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের অর্থনৈতিক ভারসাম্যে গ্রাম্য পরিবেশে দেশীয় গরু পালনে গরুত্ব দিয়েছেন গবেষকরা। ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক অ্যান্ড জেনেটিক ইভালুয়েশন অব ডিফারেন্ট ডেইরি ক্যাটল ব্রিডস আন্ডার রুরাল কন্ডিশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে আরসিসির সঙ্গে হোলিস্টিন ও দেশীয় জাতের কৃত্রিম প্রজননকৃত গরুর মধ্যে তুলনামূলকভাবে আরসিসি লাভজনক।

গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরসিসি জাতের গরু নিয়ে ১৯৯১ সালে বাকৃবির পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে প্রথম গবেষণা শুরু হয়। তখন বাকৃবির কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে এ জাতের ষাঁড় ও ডেইরি খামারে গাভী এনে গবেষণা করা হয়। পরে ২০০৪ সালে ইউএসডিএর (যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ) অর্থায়নে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় বড় পরিসরে গবেষণায় নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ২০০৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য আরো একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিএলআরআই। শুরুতে মাঠপর্যায়ে মৌলিক ও সংকর আরসিসির সংখ্যা নিয়ে জরিপ করেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা। এছাড়া চট্টগ্রামে থাকা এসব গরু অন্য এলাকায় নিলে উৎপাদনের হার কেমন হয়, তাও পরীক্ষা করা হয়। এতে গবেষকরা দেখেন, চট্টগ্রামের চেয়ে অন্য এলাকায় নিলে গরুগুলোর উৎপাদনশীলতার হার তুলনামূলকভাবে আরো বেশি। এরপর স্থানীয়ভাবে আরসিসির সংরক্ষণ এবং অন্য জেলায় সম্প্রসারণে খামারি পর্যায়ে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। সাভারে নিয়ে আসা গাভী থেকে ৩-৪ লিটার দুধ পাওয়া যেত। এছাড়া ইনব্রিডিং যেন না হয় সেজন্য ওপেন নিউক্লিয়াস ব্রিডিং সিস্টেমের (ওএনবিএস) মাধ্যমে করা হয় প্রজনন।

আরসিসিকে দেশীয় জাত হিসেবে উন্নয়নের লক্ষে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ৩৪ কোটি ৪২ কোটি লাখ টাকার একটি সরকারি প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ শুরু করেন বাকৃবি ও বিএলআরআইয়ের গবেষকরা। প্রকল্পের অধীনে সারা দেশে আবার জরিপ হয়। এতে প্রায় ৪৫ হাজার গরু পাওয়া যায় আরসিসি জাতের। ঝুঁকি এড়াতে বিকল্প হিসেবে সাভার, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় তৈরি করা হয় আরসিসির আঞ্চলিক খামার। এর বাইরেও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার অধীনে আরো কিছু গরু ছিল। প্রকল্প শেষে গবেষকরা দেখতে পান, জাত উন্নয়ন করা গাভী থেকে ৬-৮ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু গাভী আবার ৯ থেকে সাড়ে ৯ লিটার দুধও দিচ্ছে। প্রকল্পটির মাধ্যমেই দেশী এ জাতের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন গবেষকরা। গবেষকদের মধ্যে ছিলেন বাকৃবির জেনেটিকস অ্যান্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. একে ফজলুল হক ভূঁইয়া ও অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ভূঁইয়া, বিএলআরআইয়ের বর্তমান মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম, গৌতম কুমার দেব, ফারাহানা আফরোজ ও দুজন কোরিয়ান গবেষক।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আরসিসি নিয়ে গবেষণা করছেন বাকৃবির জেনেটিকস অ্যান্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. একে ফজলুল হক ভূঁইয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে যখন আরসিসি নিয়ে কাজ শুরু করি তখন বাকৃবিতে নিয়ে আসা গাভীগুলো গড়ে ৪-৫ লিটার দুধ দিত। এগুলো উন্নত ছিল। ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৫২৪ কেজিও দেখেছি। আর ২০০৫ সালে সাড়ে ৯ লিটার দুধ দেয়া আরসিসি গাভীও দেখেছি। কিন্তু বর্তমানে এ জাতের গরু অবাধ সংকরায়নের ফলে হুমকির মধ্যে রয়েছে। দেশী জাত সংরক্ষণের বিকল্প নেই। কারণ দেশী জাত না থাকলে পরবর্তী সময়ে সংকরায়নও করা যাবে না।

স্বীকৃতির বিষয়ে বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, জাত স্বীকৃতির জন্য আমাদের ১১৮টি কন্ডিশন বিভিন্ন ধাপে পূরণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে হয়েছে এর অর্থনৈতিক লাভ, দুধ ও মাংস উৎপাদন, রিপ্রডাক্টিভিটি, জীবনরহস্য উন্মোচনের তথ্য। এছাড়া দেখাতে হয়েছে কোন কারণে এ জাতের গরুর স্বকীয়তা রয়েছে। মূলত জীবনরহস্য উন্মোচন করলে অনেক বৈশিষ্ট্য বের হয়ে আসে, যার মাধ্যমে বিশ্বের অন্য জাতগুলো থেকে একে আলাদা করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রথমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সব তথ্য-উপাত্ত ও বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল সাবমিট করতে হয়েছে টেকনিক্যাল সাব-কমিটির কাছে। তাদের নির্দিষ্ট ফরম্যাট রয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে তারা জাতীয় কমিটির কাছে সুপারিশও করেছে। শিগগিরই একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরসিসিকে জাত হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়া হবে।

গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের কিছু দেশী জাতের গরু আছে, যা আকারে ছোট। দুধও দেয় এক-দেড় লিটারের মতো। এসব গরুকে বিদেশী জাত দিয়ে সংকরায়ন করানো হলে মৃত্যুঝুঁকি থাকে। তবে আরসিসির মাধ্যমে সংকরায়ণ হলে দেখা যায়, একই খাবার এবং যত্নে গাভীগুলো ৩-৪ লিটার পর্যন্ত দুধ দিচ্ছে। আরসিসি জাতের গরু আমাদের দেশের নিজস্ব সম্পদ। দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে এ পর্যন্ত কোনো স্বীকৃত জাত ছিল না। এই প্রথম কোনো জাত স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। এতে সারা বিশ্বই এখন জানবে বাংলাদেশে একটা স্বীকৃতপ্রাপ্ত জাত আছে। এ গরুর খাদ্য ও অন্যান্য খরচ একেবারেই কম এবং মাংস ও দুধ খুবই সুস্বাদু। ফলে ভালোভাবে সম্প্রসারণ করা গেলে বেশি মূল্যে রফতানিরও সুযোগ তৈরি হবে। বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক বলেন, ৬-৮ লিটার দুধ দেয়া আরসিসি সিমেন দিয়ে সংকরায়ণ করে সাড়ে চার হাজারের মতো বাছুর পেয়েছি। সেগুলোকে আরো উন্নত করতে পরবর্তী ধাপে গবেষণা করা হবে। এছাড়া ১০ হাজার সিমেন বিএলআরআইয়ের জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসব বাচ্চার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় গুরুর পারফরম্যান্স এবং এসব খামারের গরুর পারফরম্যান্স নিয়ে ধাপে ধাপে গবেষণা করা হয়েছে। জাতটির সংরক্ষণ ও গবেষণা চালু থাকবে।

জাতীয় কারিগরি নিয়ন্ত্রণ কমিটির (এনটিআরসি) সাবেক সভাপতি এসএম ফেরদৌস আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আরসিসিসহ মীরকাদিম ও পাবনা ক্যাটল এগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পদ। এনটিআরসির সভায় নতুন জাত হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আরসিসিকে সুপারিশ করা হয়েছিল।




  এ বিভাগের অন্যান্য