www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

দেশের রাজনীতিতে প্রভাব হারিয়েছে কৃষক আন্দোলন


 আনিকা মাহজাবীন    ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, রবিবার, ১১:৫৮   সম্পাদকীয় বিভাগ


জামালপুরের নান্দিনা বাজারে সম্প্রতি হঠাৎ করেই সার বিক্রি বন্ধ করে দেন ডিলাররা। আমনের ভরা মৌসুমে ডিলারদের এমন সিদ্ধান্তে বেকায়দায় পড়ে যান স্থানীয় কৃষকরা। উপায় না পেয়ে বাজারের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। আন্দোলনের মুখে এক ডিলার শুরুতে সার বিক্রির ঘোষণা দেন। কিন্তু পরে আবার কৃষি কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে সার দিতে অস্বীকৃতিও জানান। ক্ষুব্ধ কৃষকরা পরের দিন আবারো সড়ক অবরোধ করেন। জামালপুরের কৃষকদের এ সার সংকট এখনো মেটেনি।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ভূমিপুত্র আখ চাষী কৃষকদের আন্দোলন কয়েক বছর আগে জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করেছিল। সেখানে রংপুর চিনিকল স্থাপনের সময়ে আখ চাষের জন্য স্থানীয় কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ওই চুক্তিতে উল্লেখ করা ছিল—আখ চাষ না হলে জমি তার মালিকদের ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু এখন সেখানে আর আখ চাষ হয় না। উল্টো চুক্তিমতো জমি ফেরত না দিয়ে ইপিজেড নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। ওই এলাকার ভূমিপুত্র কৃষকরা এখনো জমি ফেরত পেতে আন্দোলন করছেন।

গত কয়েক বছরে সারা দেশেই কৃষকদের এমন অনেক বিচ্ছিন্ন আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত দাবিদাওয়া আদায় করে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন কৃষকরা। আলোচনায় আসা ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের কোনো আলোড়ন তুলতে পারছে না আন্দোলনগুলো। এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ হলো সামষ্টিক অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালায়ও কৃষকরা এখন অনেকটাই গুরুত্বহীন। রাজনীতিতে আলাদা শক্তি হিসেবেও পুরোপুরি প্রভাবহীন হয়ে পড়েছেন তারা।

দেশের পুরনো ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় প্রতিটিরই কৃষক সংগঠন রয়েছে। কৃষকদের নিয়ে নানা কাজ করছে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। যদিও এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই এখন আর কৃষকদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে পারছে না। এমন কৃষকদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দেশের কয়েকটি স্থানে নানা সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন দানা বাঁধতে দেখা গেলেও এর সবই গড়ে উঠেছে কৃষকদের নিজেদের উদ্যোগে। এমনকি একই সময়ে একই দাবিতে কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন হলেও সেগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সংযোগ থাকে না। নান্দিনা বাজারের মতো হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আমুবাজারেও সারের দাবিতে আন্দোলন করছেন কৃষকরা। যদিও দুটি ঘটনাই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানের কৃষক আন্দোলনগুলো অনেকটাই নির্দিষ্ট কিছু এলাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এসব আন্দোলন মূলত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক অবরোধকেন্দ্রিক। ব্যাপ্তিকালও তেমন নয়। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কৃষকদের দাবিদাওয়া পূরণ হচ্ছে না।

বাজারে সারের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানি খরচও বেড়েছে। কৃষকের শস্য উৎপাদনের ব্যয় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢের বেশি। ধারকর্জ করে কৃষক তার উৎপাদন চালু রাখলেও প্রত্যাশিত মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। বাজারে খাদ্যশস্যের দর বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এর বৃহদংশই পকেটস্থ হচ্ছে কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনের মধ্যস্বত্বভোগীদের। অথচ এখনো দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধানতম ভিত্তি কৃষি। মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশই কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত।

এর পরেও কৃষকদের জোটবদ্ধ হতে না পারার কারণ জানতে চাইলে ক্ষেতমজুর সমিতির সভাপতি ড. ফজলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের এখানে কৃষক আন্দোলন না হওয়ার পেছনে কারণ বিরাজনৈতিকীকরণ। মানুষ মনে করছে আন্দোলনের পরিবর্তে সরকারি দলের বা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা রাখলেই কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। কৃষক আন্দোলন না হওয়ার পেছনে ভয়ের সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া আমরা যারা বাম রাজনীতি করছি, দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের যেভাবে লেগেপড়ে কাজ করা দরকার, বিভিন্ন কারণে তা করতে পারছি না। আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন যেভাবে সময় দিতাম; এখন কিন্তু তরুণরা এভাবে সময় দিচ্ছে না। আমাদের পার্টিতে অনেক কৃষক নেতা ছিলেন, যেমন গুরুদাস তালুকদার, হাতেম আলী খাঁ, মনি কৃষ্ণ সেন, অমল সেন, জিতেন দত্তসহ আরো অনেকে। তারা গ্রামেগঞ্জে থেকে মানুষের সঙ্গে যেভাবে কাজ করেছেন, আমরা সেভাবে করছি না। এ রকম নেতার খুব অভাব। আমি নিজেও নই।

আয়তনে বড় দেশ হওয়ায় প্রতিবেশী ভারতের কৃষকদের জাতীয় পর্যায়ে আলাদাভাবে সংগঠিত করা তুলনামূলকভাবে বেশ কঠিন। এর পরও দেশটির কৃষকরা নিজেদের আলাদা একটি জোটবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ভারত সরকারের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে তাদের বিক্ষোভ এরই মধ্যে গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এমনকি গত বছরের জানুয়ারিতে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির লাল কেল্লা দখলে নিয়ে নিজ দেশের সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করেছিলেন তারা। ভারতের কৃষকদের এভাবে সংগঠিত করার পেছনে দেশটির আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ছোট-বড় রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো বড় ভূমিকা রেখেছিল।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল বণিক বার্তাকে বলেন, মওলানা ভাসানী, হাজী দানেশদের মতো কৃষকদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো সক্ষম কোনো নেতা এখন আর দেখা যায় না। এতে করে কৃষকদেরও এককভাবে সংগঠিত করা যায়নি। আমরা কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খুব দ্রুতই একটা সম্মেলন দেব, যেখানে আমরা কিছু বিষয় তুলে ধরব। যেমন কৃষকদের ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ দেয়া, উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য পাওয়া, সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার মতো বিষয়গুলো থাকবে।

তবে সরকারি দলের কৃষক সংগঠনের নেতারা বলছেন, দেশে এখন কৃষকদের আন্দোলন করার মতো তেমন কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম বণিক বার্তাকে বলেন, বিএনপির আমলে সার কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন বিষয় ছিল, এখন তেমন নেই। বর্তমান সরকার কৃষকবান্ধব সরকার। কৃষকদের সমৃদ্ধির জন্য সারে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। কৃষক কম দামে সার পায়। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। তাদের জন্য কৃষি যন্ত্রাংশ দেয়া হচ্ছে। কৃষকরা ভালো আছেন, আরামে আছেন। তাই তারা আন্দোলন করেন না। মানুষ তখনই আন্দোলন করে, যখন তাদের চাহিদা পূরণ হয় না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় কৃষকদের কোনো চাহিদা নেই। সার নিয়ে বিএনপির কিছু ছেলে কেলেঙ্কারি করার চেষ্টা করছে। তবে আমরা সেটিও হতে দেব না।

সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন হওয়ায় কৃষক লীগ এখন আন্দোলন না করে বরং কৃষকদের সমস্যা-সংকটগুলো নিয়ে গভীর নজরদারি চালাচ্ছে বলে জানালেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী জসীমউদ্দীন। তিনি বলেন, আমরা সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন হওয়ায় আমরা মূলত সমস্যাগুলো মনিটরিং করে থাকি। এখন কৃষকদের আন্দোলন করার মতো তেমন সংকট নেই। আমরা মূলত বাজেটের ব্যাপারে লিস্ট দিই। যেহেতু আমলারা বাজেট তৈরি করে এবং তারা সমস্যাগুলো জানে না; তাই আমরাই কৃষকদের সমস্যাগুলো তুলে ধরি। আন্দোলন মানে শুধু রাজপথে মিছিল-মিটিংই নয়। আন্দোলনেরও অনেক রকমফের আছে।

তিনি আরো বলেন, কৃষককেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিতে আমরা মহানগরেও কৃষক লীগ করব। কৃষকদের দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য ঢাকায় আসতেই হবে। যেহেতু কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তর ঢাকায়। তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য তো তাদের কমিটি লাগবে। আমরা সেজন্য ঢাকা মহানগরে সম্মেলন করে কমিটি করব।

কৃষিভিত্তিক এ দেশের একটা সময় পুরো রাজনীতির বড় অংশ জুড়ে ছিল কৃষক আন্দোলন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো চর্চা এখন আর দেখা যায় না। যদিও একসময় দেশের রাজনীতিতে এ কৃষকদেরই গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। দেশের পুরনো, ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় প্রতিটিরই তৃণমূল পর্যায়ের মূল ভিত্তি ছিলেন কৃষকরা। দলগুলোর রাজনীতির বিকাশও হয়েছে মূলত কৃষকদের কেন্দ্র করেই। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ গত শতকের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদরা রাজনীতিতে বড় হয়েছিলেন কৃষকভিত্তিক রাজনীতি করেই। তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক বিদ্রোহ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ফারাক্কা আন্দোলনসহ রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির কেন্দ্রেও ছিলেন কৃষকরা। কিন্তু গত কয়েক দশকে কৃষককেন্দ্রিক আন্দোলন দেশের রাজনীতির মূলধারা থেকে একটু একটু করে হারিয়ে গিয়েছে।

যদিও ক্ষেতমজুর সমিতির সভাপতি ড. ফজলুর রহমান এখনো কৃষক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, কৃষকদের শক্তিশালী আন্দোলন করার সম্ভাবনা আছে। যদি আমরা লেগে থাকি, গ্রামে এসে পড়ে থাকি, এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিই; জনগণ এগোতে প্রস্তুত। আমরা যদি করতি পারি, জীবন বাজি রেখে হয়তো এ মুহূর্তে কৃষকরা আসবেন না। কিন্তু নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের সাহসী করে যদি এগিয়ে নেয়া হয়, তাহলে হয়তো শিগগিরই হতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসও তাই বলে। জনগণের চাপে পড়েই আইয়ুব খানের পতন ঘটেছে। আমার মনে হয় এখন আমরা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছি তাদের নেতৃত্বের মধ্যে এখন খুবই সংকট চলছে।

কৃষক আন্দোলন এলাকা ও অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সংগঠনের অভাবকেই দায়ী করছেন সমাজকর্মী খুশি কবীর। তিনি বলেন, এখন তো সংগঠনও নেই এবং ওই সংগঠনের পেছনে তাদের সাপোর্ট দেয়ার মতো শক্তিও নেই। আগে বাম রাজনৈতিক দল বা অন্যদের একটা ভূমিকা ছিল, শক্তি ছিল। এখন কৃষক সংগঠনগুলো একদম নীরব হয়ে গিয়েছে। এগুলো নিয়ে এখন গবেষণা, আলোচনাও হচ্ছে না। সব ধরনের ফসলের ক্ষেত্রেই এখন মধ্যস্বত্বভোগী বা এজেন্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও এখন আর কৃষি সেই গুরুত্বটা পাচ্ছে না। বরং কৃষিজমিগুলো চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে।




  এ বিভাগের অন্যান্য